আমাদের স্বাস্থ্য ও চিকিৎসাবিজ্ঞান | Our health and medical science.
বাংলাদেশে চিকিৎসা ও স্বাস্থ্যসেবা খাত সাধারণত দুটি উপশাখায় বিভক্ত জনস্বাস্থ্য এবং চিকিৎসা শিক্ষা। সুস্বাস্থ্য মানুষের অন্যতম প্রধান চাহিদা এবং স্বাস্থ্যসেবার সুযোগ লাভ সবার মৌলিক অধিকার। সাম্প্রতিককালে স্বাস্থ্য ও জনসংখ্যা খাতে বাংলাদেশ উলেখযোগ্য সাফল্য অর্জন করলেও ‘সবার জন্য স্বাস্থ্য’ এ লক্ষ্যে এখনও পৌঁছানো সম্ভব হয় নি। তবে মানুষের মধ্যে ক্রমবর্ধমান স্বাস্থ্যসচেতনার কারণে স্বাস্থ্যসংশিষ্ট শাখাগুলিতে ইতিবাচক পরিবর্তন লক্ষ্য করা যাচ্ছে। চিকিৎসা, স্বাস্থ্য ও ঔষধসংক্রান্ত বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ দিকগুলি হলো।
- ইতিহাস
- স্বাস্থ্যসেবা
- রোগ-ব্যাধি
- স্বাস্থ্যনীত
- স্বাস্থ্য জনশক্তি
- চিকিৎসা শিক্ষা ও গবেষণা
- পুষ্টি শিক্ষা ও গবেষণা
- ফার্মেসি শিক্ষা ও গবেষণা
- ফার্মেসি অডিন্যান্স, ১৯৭৬
- স্বাস্থ্য অর্থনীতি
- স্বাস্থ্যসেবায় বেসরকারি সংস্থা
ইতিহাস প্রাচীন চিকিৎসাবিদ্যার শুরু আজ থেকে কয়েক হাজার বছর আগে। আদিম মানুষ রোগবালাই ও অন্যান্য দুর্যোগকে স্রষ্টার অভিশাপ, শরীরে ভূতপ্রেতের অশুভ আছর বা দুষ্টগ্রহের কুপ্রভাবের ফল মনে করত। পরবর্তী কালের মানুষ চিকিৎসাবিদ্যার অনেক উন্নতি ঘটায় এবং বিভিন্ন দ্রব্যাদি রোগের নিরাময়ে ব্যবহার করে।
বৈদিক যুগ থেকে শুরু করে বর্তমানকাল পর্যন্ত ভারতীয় চিকিৎসা পদ্ধতি আয়ুর্বেদ অর্থাৎ প্রাণবিজ্ঞান নামে অভিহিত। আত্রেয় (প্রায় ৮০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে), চরক, সুশ্রুত ও ভগবত ছিলেন আয়ুর্বেদের বিশ্রুত বিশেষজ্ঞ। প্রথম ভারতীয় চিকিৎসা বিজ্ঞানী ও শিক্ষকরূপে পরিগণিত আত্রেয় বর্তমান পাকিস্তানের তক্ষশীলার বাসিন্দা ছিলেন। বর্তমানকালেও আয়ুর্বেদের অন্যতম জনপ্রিয় নাম চরক ছিলেন বৌদ্ধরাজা কণিষ্কের রাজচিকিৎসক (২০০ খ্রিস্টাব্দ)। চরকের চিকিৎসা বিজ্ঞানের বিখ্যাত গ্রন্থটির নাম চরক-সংহিতা। বারাণসীর বাসিন্দা সুশ্রুত ভারতীয় শল্যচিকিৎসার আকরগ্রন্থ সুশ্রুত-সংহিতা লিখেছিলেন। প্রাচীন ভারতীয় চিকিৎসকগণ ভগ্ন বা স্থানচ্যুত অস্থিসন্ধির চিকিৎসা, শরীরের অর্বুদ (টিউমার), হার্নিয়া ও চোখের ছানি অপসারণে দক্ষ ছিলেন। ভারতে মুসলমান বিজয়ের পর থেকে আয়ুর্বেদ চিকিৎসার ক্রমে অবনতি ঘটতে থাকে। পাঠান ও মুগল রাজাদের আনুকূল্যে বিকশিত ইউনানি তিবিব চিকিৎসা পদ্ধতি আয়ুর্বেদের স্থান দখল করতে থাকে। এভাবে আঠারো শতকে ব্রিটিশ রাজত্বের সূচনাকাল পর্যন্ত ইউনানি তিবিব চিকিৎসার প্রসার অব্যাহত থাকে। দিলি, আগ্রা, আলীগড়, লক্ষ্ণৌ, হায়দ্রাবাদ এসব নগরকে কেন্দ্র করে ইউনানি চিকিৎসা বিকশিত হয়েছিল। ১৮১০ ও ১৮৩৯ সালের মধ্যবর্তী সময়ে জার্মান চিকিৎসক স্যামুয়েল হ্যানিম্যানের হোমিওপ্যাথি চিকিৎসা ভারতে গ্রহণযোগ্যতা পায় এবং এখনও এই চিকিৎসার জনপ্রিয়তা অব্যাহত রয়েছে।
বর্তমান বাংলাদেশ ভূখন্ডে এলোপ্যাথিক চিকিৎসার প্রচলন হয় ব্রিটিশ আমলে। প্রাথমিক অবস্থায় হাতে গোনা কয়েকজন প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত এলোপ্যাথিক ডাক্তার ছিলেন। এদেশের প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণ সুদৃঢ় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ব্রিটিশরা দক্ষ ইংরেজ চিকিৎসক নিয়োগের এবং স্বাস্থ্যখাতে পরিবর্তন আনার প্রয়োজন অনুভব করে। ১৮৫৯ সালে বহু বেসামরিক লোক ও সেনা সদস্যের মৃত্যুর কারণ অনুসন্ধানের জন্য একটি রয়েল তদন্ত কমিশন ভারতে পাঠানো হয়। কমিশন প্রতিটি প্রেসিডেন্সিতে একটি করে জনস্বাস্থ্য কমিশন গঠনের সুপারিশ করে। ১৮৬৪ সালে বোম্বে, মাদ্রাজ ও বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির প্রত্যেকটির জন্য প্রতিটি ৫ সদস্যের ৩টি স্যানিটারি কমিশন গঠিত হয়। সিভিল সার্জনরা পদাধিকারবলে জেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োগ পান। ১৮৬৯ সালে মেডিক্যাল অফিসার পদের নাম বদলে স্যানিটারি কমিশনার রাখা হয়। সরকার ওই বছরই কেন্দ্রে ও অন্যান্য রাজ্যে কয়েকজন স্যানিটারি কমিশনার নিযুক্ত করে। ১৮৭৩ সালে আইনের মাধ্যমে জন্মমৃত্যু নিবন্ধন বাধ্যতামূলক করা হয়। ১৮৮০ সালে গুটিবসন্তের টিকা নেওয়ার জন্য আইন এবং ১৮৮১ সালে প্রথমবারের মতো ভারতীয় শিল্পকারখানা আইন চালু হয়। ১৮৯৬ সালে হাজার হাজার লোক পেগ রোগে মারা যায় এবং সরকার একটি পেগ কমিশন গঠন করে। ১৮৯৭ সালে সংক্রামক ব্যাধি আইন ঘোষিত হয় এবং ১৯০৪ সালে পেগ কমিশন তাদের রিপোর্ট প্রকাশ করে। কমিশন জনস্বাস্থ্য সংস্থাগুলি পুনর্গঠনের সুপারিশ করে। অন্যান্য প্রদেশের মতো বাংলার স্যানিটারি কমিশনার জনস্বাস্থ্য বিভাগের প্রধান হিসেবে নিয়োগ পায় এবং সংস্থার অফিস সার্জন জেনারেলের নিয়ন্ত্রণের বাইরে থাকে। স্যানিটারি কমিশনার সরাসরি কেন্দ্রীয় সরকারের অধীনে কাজ শুরু করে।
শহীদ সোহরাওয়ার্দী হাসপাতাল কমপেক্সের ভিতরেই ১৯৮০-এর দশকে National Institute of cardio-vascular Diseases (NICVD) এবং National Institute for Opthalmology প্রতিষ্ঠান দুটির কার্যক্রম শুরু হয়। নিপসম (National Institute of Preventive and Social Medicine/NIPSOM) গঠিত হয় ১৯৮০ সালে এবং কলেরা হাসপাতাল আন্তর্জাতিক উদরাময় রোগ গবেষণা কেন্দ্র আইসিডিডিআর,বি (International Centre for Diarrhoeal Diseases Research, Bangladesh/ICDDR,B) নামে পরিবর্তিত হয়। একই সময় গড়ে ওঠে বাংলাদেশ ডায়াবেটিক অ্যাসোসিয়েশন কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত ও পরিচালিত বারডেম (BIRDEM) হাসপাতাল।
স্বাস্থ্যসেবা (Healthcare) স্বাস্থ্য ও জনসংখ্যা খাতে কিছু উলেখযোগ্য সাফল্য অর্জন করা সত্ত্বেও গত ৪০ বছরে বাংলাদেশে স্বাস্থ্যসেবা বিতরণে সমতাপূর্ণ অবস্থা সৃষ্টি করা সম্ভব হয় নি। অর্থের অভাব এবং অনুপযুক্ত চিকিৎসা সেবা সরবরাহের ফলে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর চিকিৎসার সুযোগ-সুবিধা সংকুচিত হয়েছে। চতুর্থ পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার (১৯৯০-১৯৯৫) স্বাস্থ্য বিষয়ক অনুচ্ছেদের প্রারম্ভে বলা হয়েছে ‘স্বাস্থ্যসেবা পাওয়া যেকোন ব্যক্তির মৌলিক অধিকার’। পঞ্চম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় (১৯৯৭-২০০২) বলা হয়েছে ‘চিকিৎসা সেবা প্রদান করা সরকারের একটি সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা’। দেশের স্বাস্থ্য পরিস্থিতির পরিবর্তনের প্রেক্ষাপটে স্বাস্থ্যখাতে, বিশেষত ব্যবস্থাপনা কাঠামো, সেবাপ্রদান ব্যবস্থা এবং সরকারি ও বেসরকারি সম্পদ ব্যবহারের ক্ষেত্রে সংস্কারের উদ্যোগ গৃহীত হয়েছে। সারা বিশ্বে স্বাস্থ্য পরিস্থিতি পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশেও সময়ের ব্যবধানে স্বাস্থ্য পরিস্থিতির চিত্র বদলে যাচ্ছে। এসব পরিবর্তনের প্রধান কারণগুলির মধ্যে রয়েছে দ্রুতহারে জনসংখ্যা বৃদ্ধি, ক্রমবর্ধমান নগরায়ণ ও দেশে বিরাজমান রোগব্যাধির প্রকৃতি পরিবর্তন। ম্যালেরিয়া ও কালাজ্বরের পুনরাবির্ভাব, ডেঙ্গু, গোদ, যক্ষমা ইত্যাদি নতুন ও পুনরাবির্ভূত রোগের অল্প কয়েকটি দৃষ্টান্ত। এছাড়া যৌনরোগ, এইডস জনস্বাস্থ্যের জন্য বিপজ্জনক সংক্রামক রোগব্যাধি ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পাচ্ছে। হূদরোগ, বৃক্কের ব্যাধি, মানসিক অসুস্থতা, ক্যানসার এবং ধূমপান ও মদ্যপানের সঙ্গে সংশিষ্ট রোগব্যাধিও বাড়ছে। বাংলাদেশের অনেক অঞ্চলে ভূগর্ভস্থ পানিতে আর্সেনিকের বর্ধিত মাত্রা জনস্বাস্থ্যের জন্য এক সম্ভাব্য বিপদ হিসেবে দেখা দিয়েছে। সম্ভবত বাংলাদেশে কিছু রোগের প্রাদুর্ভাব বেড়ে যাবে এবং পুরনো রোগব্যাধি ও নতুন উদ্ভূত সংক্রামক রোগব্যাধি পাশাপাশি বিরাজ করবে। অপুষ্টি, যক্ষমা, প্রজনন স্বাস্থ্যের সমস্যা, উদরাময়, শ্বাসনালীর সমস্যা ইত্যাদির প্রভাব জনগণের ওপর অব্যাহত থাকবে।
চতুর্থ পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ খাতের পর্যালোচনা করে পঞ্চম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় বলা হয়েছে যে, স্বাধীনতা-উত্তর ২৫ বছরে জনগণের স্বাস্থ্য পরিস্থিতির উলেখযোগ্য উন্নতি হয়েছে। গুটিবসন্ত, কলেরা ও ম্যালেরিয়া নির্মূল হয়েছে বা এগুলি অন্তত এখন আর প্রধান প্রাণহরণকারী রোগ নয়। ১৯৭০ সালে গড় আয়ু ছিল ৪৫, তা বৃদ্ধি পেয়ে ২০০০ সালে হয় ৬০.৮। ১৯৭৫ সালে মোট জন্মহার ছিল ৬.৩, ১৯৯৫ সালে তা হ্রাস পেয়ে হয় ৩.৪। ১৯৯০-তে মৃত্যুহার ছিল ১২.০, ১৯৯৫ সালে তা হ্রাস পেয়ে হয় ৯.০ এবং তা আরও হ্রাস পাচ্ছে। ১৯৯৫ সালে সম্প্রসারিত টিকাদান কর্মসূচির আওতায় টিকাদান সম্পন্ন হয় ৬৬ শতাংশ। ১৯৯৫-তে শিশুমৃত্যুর হার হ্রাস পেয়ে হয় প্রতি হাজারে ৭৮। অনুরূপভাবে পাঁচ বছরের কমবয়সী শিশু মৃত্যুর হার ১৯৭০ দশকে ছিল প্রতি হাজারে ২১০-এর অধিক, ১৯৯৫-তে তা নেমে আসে প্রতি হাজারে ১৩৩ জনে।
স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা ক্ষেত্রে প্রধান চ্যালেঞ্জগুলি হচ্ছে প্রাথমিক সেবাপ্রাপ্তি সম্প্রসারণ এবং সরকারি ও বেসরকারি উভয় খাতে সেবার মান উন্নয়ন। সরকার কর্তৃক প্রণীত স্বাস্থ্য ও জনসংখ্যা বিষয়ক নীতিমালা (১৯৯৮ থেকে বাস্তবায়নাধীন) প্রণয়ন সাম্প্রতিককালের এক বিরাট অর্জন। স্বাস্থ্য ও জনসংখ্যা খাত বিষয়ক নীতিমালা প্রণীত হয়েছে বিভিন্ন পর্যায়ের জনগণের ব্যাপক অংশগ্রহণভিত্তিক একটি প্রক্রিয়ায়। সরকার তা অনুমোদনের পর স্বাস্থ্য ও জনসংখ্যা খাতের কর্মসূচি বাস্তবায়ন শুরু করেছে। ১৯৯৮-২০০০-এর মধ্যে স্বাস্থ্যখাতে আরেকটি উলেখযোগ্য সাফল্য হচ্ছে প্রথমবারের মতো দেশে একটি জাতীয় স্বাস্থ্যনীতি প্রণয়ন ও সরকার কর্তৃক তার অনুমোদন। নতুন জাতীয় স্বাস্থ্যনীতি অনুসারে স্বাস্থ্য ও জনসংখ্যা খাত বিষয়ক নীতিমালা কাটছাট করা হয়েছে। এটা সম্ভব হয়েছে স্বাস্থ্য ও জনসংখ্যা খাত বিষয়ক নীতিমালা ও জাতীয় স্বাস্থ্যনীতি প্রণয়নের কাজ প্রায় একই সময়ে শুরু হয়েছিল বলে।
স্বাস্থ্য পরিস্থিতি সাম্প্রতিক স্বাস্থ্য ও জনসংখ্যাতাত্ত্বিক জরিপের এক রিপোর্টে বলা হয়েছে, গ্রামাঞ্চলে ৪১ শতাংশ মানুষ অসুস্থতার কারণে জনপ্রতি বছরে ১০ কর্মদিবস হারায়। মাথাপ্রতি বাৎসরিক চিকিৎসা খরচ তুলনামূলকভাবে বেশি শহরাঞ্চলে ৯০০ টাকা, গ্রামাঞ্চলে ৬০০ টাকা। উভয় অঞ্চলে এই খরচের পরিমাণ আঞ্চলিক মাসিক দারিদ্র্য সীমারেখার সমান বা তার চেয়ে বেশি।
জন্মহার কমেছে, শিশুদের টিকাদান প্রায় ৭০ শতাংশে পৌঁছেছে। ১৯৮১ থেকে ১৯৯২-এর মধ্যে চিকিৎসক জনসংখ্যার অনুপাত অর্ধেক হ্রাস পেয়ে হয় ১ : ৫২৪২ এবং ২০০০-এর শেষ নাগাদ তা দাঁড়ায় ১ : ৪৭১৯। নার্স ও জনসংখ্যার অনুপাত ১ : ৮২২৬। ২০০০ সালে নিবন্ধনকৃত চিকিৎসকের সংখ্যা ২৭,৫৪৬, নিবন্ধনকৃত নার্সের সংখ্যা ১৫,৮০৪। ২০০০ সালে হাসপাতাল শয্যার সংখ্যা ৪০,৭৯৩, তন্মধ্যে ২৯,৪০২টি সরকারি হাসপাতালের। বেসরকারি হাসপাতাল ১৩টি, সরকারি হাসপাতালের সংখ্যাও ১৩।
‘স্বাস্থ্যবান বাংলাদেশের সন্ধানে: একুশ শতকের প্রত্যাশা’ শিরোনামে বিশ্বব্যাংকের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, অপুষ্টি ও শিশুমৃত্যুর দিক থেকে বাংলাদেশের স্থান তালিকার শীর্ষে। এর কারণ হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে দারিদ্র্য, নিরক্ষরতা এবং প্রধানত অপর্যাপ্ত স্বাস্থ্যসেবা। বাংলাদেশে ৭০ শতাংশ মা ও শিশু অপুষ্টির শিকার। প্রতিদিন ৬০০ শিশুর মৃত্যু ঘটে অপুষ্টির কারণে এবং প্রতি বছর ২৮,০০০ মায়ের মৃত্যু ঘটে গর্ভধারণসংক্রান্ত রোগব্যাধি ও জটিলতায়। বছরে ৩৩ লাখ ৩০ হাজার শিশুর জন্ম হয়, এর মধ্যে এক-তৃতীয়াংশের (১১ লাখ ১০ হাজার) জন্মকালীন দৈহিক ওজন হয় স্বাভাবিকের চেয়ে কম। পাঁচ বছরের কমবয়সী শিশুদের দুই-তৃতীয়াংশ অপুষ্টিতে ভোগে। ছয় থেকে ৭ মাস বয়সী শিশুদের স্বাভাবিক দৈহিক বৃদ্ধি ঘটে না। সন্তান জন্মদানের সময় প্রতি ১০০০ প্রসূতির মধ্যে ৫ জন মারা যায়। প্রতি ৯ জনের মধ্যে ১ জন শিশু পাঁচ বছর বয়সের আগে মারা যায়। দরিদ্রতমদের মধ্যে এই হার প্রতি ৬ জনে ১ জন। শিশুমৃত্যুর প্রধান কারণগুলির মধ্যে রয়েছে নিউমোনিয়া, উদরাময়, অপুষ্টি, হাম এবং জন্মের সময় ধনুষ্টংকার। দেশে পাঁচ বছরের কমবয়সী শিশুর সংখ্যা ২ কোটি। তন্মধ্যে ৩ লাখ ৮০ হাজার প্রতিবছর মারা যায়। এর মধ্যে নিউমোনিয়ায় ১ লাখ ২০ হাজার, উদরাময়ে ৯৫ হাজার, ধনুষ্টংকারে ১৯ হাজার ও হামে ১৫ হাজার।
সন্তোষজনক অবকাঠামো সত্ত্বেও স্বাস্থ্যসেবা সিংহভাগ জনগোষ্ঠীর নাগালের বাইরে রয়ে গেছে। স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি বিভাগের সাম্প্রতিক গবেষণা অনুসারে, স্বাস্থ্যখাতে মোট ব্যয়ের মাত্র ৩৪ শতাংশ সরকারি, ৬৪ শতাংশ পরিবারগুলি নিজেরাই বহন করে এবং মাত্র দুই শতাংশের উৎস বেসরকারি সংস্থাগুলি। ১৯৯৭-৯৮ সালে স্বাস্থ্যখাতে মোট বরাদ্দ ছিল ১৪৮০ কোটি টাকা বা জিডিপি’র ১.৩ শতাংশ বা মাথাপিছু বার্ষিক ১১৭ টাকা।
জেলা হাসপাতালগুলির ধারণক্ষমতা অপেক্ষা রোগীর সংখ্যা বেশি হওয়ায় সেগুলিতে সাধারণত অতিরিক্ত ভিড় লেগে থাকে। কিন্তু নিম্নতর পর্যায়ের চিকিৎসা সুবিধাগুলি অব্যবহূত থেকে যায় মূলত জনসাধারণের আস্থার অভাবে। স্বাস্থ্য ও জনসংখ্যা খাত বিষয়ক নীতিমালার ভিত্তিতে প্রণীত এবং ১৯৯৮ থেকে বাস্তবায়নাধীন নতুন স্বাস্থ্য ও জনসংখ্যা খাত বিষয়ক পঞ্চবার্ষিক কর্মসূচির আওতায় সমগ্র জনগোষ্ঠীকে চারটি ভিন্ন ভিন্ন পর্যায়ে একটি অত্যাবশ্যকীয় সেবা প্যাকেজ (ESP) বা কমিউনিটিভিত্তিক স্বাস্থ্যসেবা প্রদানের কর্ম-পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে। পর্যায়গুলি হলো কমিউনিটি আউট-রিচ, স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্র বা গ্রামীণ চিকিৎসা কেন্দ্র, প্রথম রেফারেল ব্যবস্থা হিসেবে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপেক্স এবং দ্বিতীয় রেফারেল ব্যবস্থা হিসেবে জেলা হাসপাতাল। স্বাস্থ্য কর্মসূচিতে সরকারি-বেসরকারি খাতের সহযোগিতা স্বাস্থ্য ও জনসংখ্যা খাত বিষয়ক নীতিমালার একটি অংশ, যার লক্ষ্য বেসরকারি খাতকে কাজে লাগিয়ে বিশেষত নারী ও শিশুসহ দরিদ্র জনগোষ্ঠীর উন্নতমানের স্বাস্থ্যসেবা প্রাপ্তির সুযোগ বৃদ্ধি করা। শিশুস্বাস্থ্য, প্রজনন স্বাস্থ্য, বয়ঃসন্ধিকালীন স্বাস্থ্য, পরিবার পরিকল্পনা, সংক্রামক ব্যাধি এবং নিরাময় সেবাকে অত্যাবশ্যকীয় সেবা প্যাকেজ-এর অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এগুলি বাংলাদেশের অগ্রাধিকারমূলক প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবার দিক। বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলে বসবাসরত মানুষ যাদের স্বাস্থ্যসেবা প্রাপ্তির সুযোগ অল্প, তাদের জন্য প্রাথমিক স্বাস্থ্য পরিচর্যা প্রদানের উদ্দেশ্যে একটা সেবাপ্রদান ব্যবস্থা গড়ে তোলা এগুলির লক্ষ্য।
দরিদ্র মানুষ, বিশেষত নারী ও শিশুদের কাছে মানসম্পন্ন স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছানোর কাজে স্বাস্থ্য ও জনসংখ্যা বিষয়ক কর্মসূচিগুলিতে বেসরকারি খাতের অনেক সাফল্য রয়েছে। ব্র্যাক-এর কমিউনিটিভিত্তিক স্বাস্থ্য ও জনসংখ্যা বিষয়ক কর্মসূচি তেমন সাফল্যের অধিকারী একটি সংস্থা, যারা কমিউনিটির স্বাস্থ্যকর্মীদের এবং জনগোষ্ঠীর অংশগ্রহণমূলক তৎপরতাকে কাজে লাগিয়ে সেবাপ্রদান করছে। কয়েক দশক ধরে ব্র্যাক ঘরে ঘরে গিয়ে এবং স্থানীয় জনগোষ্ঠীকে সংশিষ্ট করে প্রত্যন্ত অঞ্চলে স্থায়ী সেবাকেন্দ্রগুলির মাধ্যমে সাফল্যের সঙ্গে স্বাস্থ্যসেবা প্রদান করে আসছে। ব্র্যাকের স্বাস্থ্যসেবার কয়েকটি সাফল্যজনক ক্ষেত্রের মধ্যে রয়েছে সম্প্রসারিত টিকাদান কর্মসূচি, যক্ষ্মা কর্মসূচি, পরিবার পরিকল্পনা এবং প্রসবপূর্ব ও প্রসব-পরবর্তীকালীন সেবা ও পরিচর্যা।
গ্রামীণ স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলি ডাক্তারদের এবং তাদের উপকেন্দ্রগুলি প্যারামেডিকদের দ্বারা পরিচালিত হয়। কেন্দ্রগুলি মূলত গুরুতর অসুস্থ রোগীদের প্রতি এবং তাদের পরবর্তী ধাপের চিকিৎসার জন্য অন্যত্র রেফার করার বিষয়ে মনোযোগ দেয়। ঢাকা শহরে ও তার আশেপাশে এদের তিনটি অলাভজনক হাসপাতাল রয়েছে। অর্থের বিনিময়ে স্বাস্থ্যসেবা প্রদানের একটি ব্যবস্থাও গড়ে তোলা হয়েছে, যার এক-তৃতীয়াংশ খরচ কেন্দ্রগুলি নিজেরাই বহন করে। মোট ব্যয়ের ৬৬ শতাংশ অর্থ স্থানীয়ভাবে সংগৃহীত হয়। মাথাপিছু বার্ষিক আবর্তক ব্যয় মাত্র ০.৩৭ মার্কিন ডলার।
গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র চারটি উপকেন্দ্রের মাধ্যমে কমিউনিটিভিত্তিক স্বাস্থ্যসেবা পরিচালনা করে। এসব উপকেন্দ্রের নিয়মিত কর্মকর্তারা প্যারামেডিকস, তবে একজন ডাক্তার সপ্তাহে দুদিন সেখানে রোগীদের সাক্ষাত দেন। এসব উপকেন্দ্র গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র হাসপাতালের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পৃক্ত। উপকেন্দ্রগুলি প্রয়োজনমতো রোগীদের এই হাসপাতালে পাঠায়। উপকেন্দ্রগুলির প্যারামেডিকরা নিয়মিতভাবে রোগীদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে মৌলিক স্বাস্থ্যসেবা ও স্বাস্থ্যবিষয়ক শিক্ষা দিয়ে থাকে।
ঢাকা কমিউনিটি হাসপাতাল কিছু গ্রামীণ প্রাথমিক স্বাস্থ্য পরিচর্যা ক্লিনিক এবং সেখান থেকে পরবর্তী চিকিৎসার জন্য পাঠানো রোগীদের জন্য রাজধানীতে অবস্থিত ৫০ শয্যাবিশিষ্ট একটি হাসপাতাল পরিচালনা করে। ক্লিনিক কর্মসূচিটি স্বয়ংসম্পূর্ণ। গ্রামীণ ক্লিনিকগুলিতে প্রত্যেক সদস্য মাসে ১০ টাকা প্রদান করে এবং তার বিনিময়ে স্বাস্থ্যকর্মীরা মাঝে মাঝে তাদের বাড়িতে গিয়ে রোগী দেখে এবং তারা ক্লিনিকে একজন ডাক্তারের পরামর্শ পায়।
আইসিডিডিআর,বি-এর গবেষণা ক্ষেত্রে উদ্ভাবনীমূলক কর্মকান্ড বাস্তবায়নের ব্যাপক অভিজ্ঞতা রয়েছে। মতলবে অবস্থিত মা ও শিশুস্বাস্থ্য পরিবার পরিকল্পনা প্রকল্প (MCH-FP) বাংলাদেশে কমিউনিটি পর্যায়ে অত্যাবশকীয় সেবা প্যাকেজের অধিকাংশ ক্ষেত্রে কাজের সবচেয়ে দীর্ঘ ও বিশদ অভিজ্ঞতা। নিরাপদ মাতৃত্ব নিশ্চিতকরণ ও প্রজনননালীর সংক্রমণের চিকিৎসাসহ প্রজনন স্বাস্থ্য বিষয়ক নানা কর্মসূচি গঠনে আইসিডিডিআর,বি-এর অভিজ্ঞতা গত দুই দশকের উলেখযোগ্য অর্জন।
স্বাস্থ্যসেবার বিভিন্ন পর্যায়ে মেডিক্যাল ও শল্যচিকিৎসার চাহিদায় সম্পদ বরাদ্দের বিষয়টি অবহেলিত রয়ে গেছে। মেডিক্যাল কলেজগুলির সঙ্গে সংযুক্ত সব হাসপাতাল শয্যা প্রতি বার্ষিক ২৫ হাজার টাকা (প্রায় ৫০০ মার্কিন ডলার) বরাদ্দ পায়, বাস্তবতার সঙ্গে যার কোন সম্পর্ক নেই। জেলা পর্যায়ের হাসপাতালগুলি শয্যা প্রতি বার্ষিক ১৮ হাজার টাকা ও থানা পর্যায়ের হাসপাতালগুলি শয্যা প্রতি বার্ষিক ১০ হাজার ৫ শত টাকা বরাদ্দ পায়। শহর এলাকায় প্রতিটি হাসপাতাল ৭০ হাজার টাকা পায়। ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্রগুলি পায় বার্ষিক ৪০ হাজার টাকা। কেন্দ্রীয় মেডিক্যাল সামগ্রী ভান্ডার চিকিৎসা সরঞ্জাম, যন্ত্রপাতি ও অন্যান্য প্রধান সামগ্রী ক্রয় বাবদ মোট তহবিলের ২০ শতাংশ থোক বরাদ্দ পায়। বিগত কয়েক বছরে দেশে মানসম্পন্ন চিকিৎসা সেবা প্রদানে সক্ষম কিছু আধুনিক হাসপাতাল গড়ে উঠেছে। সেগুলির মধ্যে উলেখযোগ্য ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশন, সিকদার মেডিক্যাল কলেজ অ্যান্ড হসপিটাল, সেন্ট্রাল হসপিটাল, জাপান-বাংলাদেশ ফ্রেন্ডশিপ হসপিটাল, বাজিতপুর মেডিক্যাল কলেজ অ্যান্ড হসপিটাল, ঢাকা কমিউনিটি হসপিটাল ইত্যাদি। ইউনিসেফ কর্তৃক প্রকাশিত ‘বিশ্বের শিশুদের অবস্থা ২০০১’ শীর্ষক প্রতিবেদন অনুযায়ী, শিশুমৃত্যুর হারের ক্ষেত্রে ১৮১টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ নিচের দিক থেকে ৫৩তম স্থানে রয়েছে।
পোস্টের নিয়মিত আপডেট পেতে আমাদের ‘‘Facebook Page” লাইক দিয়ে রাখুন।
আর্টিকেলটি ভালো লাগলে নিচের ফেসবুক, টুইটার বা গুগল প্লাসে
শেয়ার করে আপনার টাইমলাইনে রেখে দিন। এতক্ষণ সঙ্গে থাকার জন্য ধন্যবাদ।
No comments